বিপ্লব ভট্টাচার্য এক অবহেলিত নায়ক।

বিপ্লব ভট্টাচার্য এক অবহেলিত নায়ক।






ছোট বেলায় দক্ষিণ এশিয়া গেমস অনুষ্ঠিত হত যা বর্তমান SA গেমস নামে পরিচিত। SA গেমস  প্রতিযোগীতার সবচেয়ে আকষণীয় ইভেন্ট ছিল ফুটবল। সবাই মুখিয়ে বসে থাকতো কারা এই ইভেন্টের স্বর্ণ জয় করবে। বাংলাদেশ প্রতিবারেই টপ ফেভারিট হয়ে টুনামেন্টে যেত। কিন্ত প্রতিবারই হতাশ করতো। কখনো কাইনালে গিয়ে শিরোপার খুব কাছে গিয়েও এক অজানা কারনে শিরোপা আর ছোয়া হত না, এক সময়ে এই পদক সোনার হরিণে পরিনত হয়। সাধারণ  মানুষও আস্তে আস্তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে  ফুটবলের প্রতি। ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর  ফুটবলের জনপ্রিয়তা এমনিতেই কমে যায়। তাই ৯৯ সালের SA গেমসের ফুটবিল নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে খুব একটা প্রত্যাশা ছিল না। যে বাংলাদেশ এক সময় মালদ্বীপ ও ভূটানকে নিয়ে ছেলেখেলা করে জিততো সেই মালদ্বীপ ও ভূটানও অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
এই রকম এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয় ৮ম এস এ গেমসের আসর। এই আসরে ফুটবল ইভেন্ট নিয়ে মানুষের সেই রকম প্রত্যাশাও নেই, কেননা হয়তো সেমি ফাইনাল অথবা ফাইনালে গিয়ে যথারীতি আবারো শিরোপা বঞ্চিত হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ৩ বার ফাইনালে গিয়ে সবাইকে হতাশ করেছে। ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত সবার কাছে ফুটবল নিয়ে সেরকম প্রত্যাশাও নেই। এমনই সময় গেমসের বাংলাদেশ ১ম ম্যাচে মালদ্বীপের কাছে পরাজিত হয়ে পরের ম্যাচে শ্রীলংকাকে হারিয়ে সেমিতে পেলো শক্তিশালী ভারতকে। ভারতের কাছে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা হয়ে উঠেছে ডাল ভাতের মতন।সেই ভারতকে ১ গোলে পরাজিত করে উঠে গেল ফাইনালে, সেমি ফাইনালে মধ্যমাঠ থেকে টিপু একটি অসাধারণ গোল করেন।এবার একটু নড়েচড়ে বসলো বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমিকরা, দেখা যাক এবার কী হয়। কাইনালে মুখোমুখি স্বাগতিক নেপালের সাথে। হিমালয় কন্যা নেপালে ফুটবল বেশ জনপ্রিয় খেলা। নেপালের মাঠে  অনুষ্ঠিত ম্যাচে স্টেডিয়াম ভর্তি নেপালী দর্শকদের সামনে বাংলাদেশ এমনিতেই কিছুটা ব্যাকফুটে কিন্ত অবিশ্বাস্য ভাবে ১ গোলে জিতে যায়। অনেকটা অপ্র্যাতাশিত ভাবে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। সমগ্র টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলের যে কজন খেলোয়াড়ের খেলা মার্ক করার মতন ছিল তাদের ভিতর একজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে বললে চলে আসবে একজনের নাম গোল রক্ষক বিপ্লব ভট্টাচার্য নাম। নেপালে গিয়ে তিনি যেন হিমালয় পর্বতের মতনই দূর্ভেদ্য পাহাড় হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে সেমিতে ভারতের বিপক্ষে একের পর এক আক্রমন তিনি হিমালয়ের মতন বাধা হয়ে দাড়িয়েছিলেন। আর ফাইনালেও ছিলেন চিনের মহাপ্রাচীর হয়ে। নেপালের শত চেষ্টাও গোল শোধ করতে পারে নি। দীর্ঘ দিনের সোনার মেডেলে জন্য যে হাহাকার ছিল তা পূরণ হল এই বারের আসরে। গোলরক্ষক বিপ্লব ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন ফুটবলার এই টুনমেন্টে উল্লেখ করার মতন খেলেছিলেন, টিপু, আলফাজ, জুয়েল রানা, প্রমুখ। ভারতের সাথে খেলায় মাঝমাধ থেকে টিপুর সেই বিখ্যাত গোলটি দেখার মতন ছিল, সেই সাথে বাংলাদেশের রক্ষণভাগ বেশ দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। এই দেশে ফুটবলে সাফল্য খুব একটা বেশী নাই। এর আগে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত একটি মাত্র টুর্নামেন্টে  চ্যাম্পিয়ন হওয়া ছাড়া আর এমন কোন সাফল্য ছিল না। দক্ষিণ এশিয়াতেও আস্তে আস্তে দূর্বল দলে পরিণত হয়ে গেছিল। যে ভূটান - মালদ্বীপের সাথে গোলের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হত তাদের সাথেই হোচট খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই ৮ম SA গেমসে ফুটবলে সোনার মেডেল পাওয়াটা ছিল অনেকটা অক্সিজেনের মতন। 


১৯৯৯ সালে SA গেমস এ চীনের প্রাচীর বিপ্লব ভট্টাচার্য।

গোলরক্ষক  বিপ্লব দীর্ঘদিন জাতীয় দলের গোল রক্ষকের ভূমিকা পালন করেন৷ কিছুদিন অধিনায়কত্বও করেছেন। খেলোয়াড়ী জীবনে ঢাকা আবাহনীতে দীর্ঘ ১০ বছর, শেখ রাসেলে ৫ বছর, এছাড় ঢাকা মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়ন,মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়েও খেলেছেন। ঢাকা আবাহনীর অধিকাংশ সাফল্য উনার অবদান  ছিল। আবার ব্রাদার্স ইউনিয়ন তাদের একমাত্র লীগ শিরোপা বিজয়ী দলে উনি ছিলেন। একটি বিশেষ সাফল্য উনি অর্জন করেছেন যা আজ অবধি অন্য কেউ অর্জন করতে পারবে কিনা সন্দেহ। বিপ্লবকে দক্ষিণ এশীয় ফুটবল ফেডারেশন কর্তৃক ১০ই সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে সম্মানিত করা হয়েছিল, আটটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে তার দেশের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে।যা কিনা এক অনন্য অর্জন। উনার সময়ে উনাকে খেলতে হয়েছে আরেক দেশ সেরা গোল রক্ষক আমিনুলের সাথে। আমিনুল- বিপ্লব ২ জনই সেরা ছিল। তাই তাদের প্রতিদ্বদ্বিতাও বেশ জমতো। দীর্ঘদিন ফুটবল খেলার পর উনি ২০১৭ সালে অবসর নেন। অবসরের পর কোচিং এ জড়িয়ে পরেন। খেলোয়াড়রা  সাধারণত খেলা ছেড়ে দিলে খেলা সংশ্লিষ্ট পেশায় জড়িয়ে পড়েন। কেউ কোচিং এ, আবার কেউ ক্রীড়া কর্মকর্তা হিসাবে। কিছু দিন জাতীয় দলের গোল কিপিং কোচ হিসাবে ছিলেন। এদেশেতো মেধার মূল্যায়ন হয় না। তাই এদেশের ফুটবলের প্রতি অভিমাণ করে পাড়ি জমিয়েছিলেন  কম্বোডিয়াতে। ঐ খানে একটি ফুটবল একাডেমীতে গোল কিপিং কোচ হিসাবে। কিছুদিন হল দেশে ফিরে এসেছেন। দেশের ফুটবল নিয়ে কাজ করার জন্য। সম্প্রতি দেশে লীগে খেলার জন্য বিদেশী গোল রক্ষক আনার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, দেশে আন্তজাতিক মানের অনেক গোল রক্ষক আছে, জিকো, মিতুল মার্মা সহ অনেকেই আছে। অপ্রয়োজনিও ভাবে বিদেশ থেকে গোল রক্ষক আনার প্রয়োজন নাই। এতে দেশে সম্ভবনাময় দেশী ফুটবলাররা সুযোগ পাবে না। বিপ্লব, আমিনুল, শ্রদ্ধেয় মহাসিন, কানন, আতিকদেরকে দেখে জিকো, মিতুল মার্মাদের প্রজন্ম এসেছে, তাই অযাথা বিদেশ থেকে গোল রক্ষক আনার দরকার নাই।  বিল্লবকে আমরা সেই রকম ভাবে মূল্যায়িত করতে পারি নি। দীর্ঘ সময়ে ফুটবলে থেকে ফুটবলকে যখন কিছু দিতে চাচ্ছে আমরাই যেন তা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। আশা করি দেশের ফুটবল নিয়ে তিনি আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়ুক। 


লেখক: জুয়েল মাহমুদ।

Comments

Popular posts from this blog

হারিয়ে যাওয়া কিছু বাংলা ব্যান্ড।

সোনার মুকুট আর ছাগল কান্ড!!

১০টি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া যা আপনার দৈনন্দিন জীবনে খুবই উপকারী।