আর্ক ব্যান্ড ৯০ এর শেষ উচ্ছাস।
আর্ক এর বিখ্যাত তিন মাঝি। |
সৃষ্টিকর্তা হযরত নূহ (আঃ) কে একটি বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি বড় নৌকা নির্মাণের নির্দেশ দেন।হযরত নূহ (আঃ) তার অনুসারীদেরকে সম্ভাব্য মহাপ্লাবন থেকে বাঁচানোর জন্য একটি বিশাল নৌকা তৈরি করলেন একে একে সব সম্প্রদায় থেকে তিনি জোড়ায় জোড়ায় প্রাণী তুললেন, ৪০ দিন একটানা বন্যা হল, মহাপ্লাবনের সময় নির্মিত নৌকার করে নিজের পরিবার ও পৃথিবীর সকল প্রাণীর এক জোড়াকে রক্ষা করেছিলেন। ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মমতে সেই বিখ্যাত নোকটির নাম হল 'Ark'। সেই নৌকাটি আজও বিজ্ঞানীরা খুজে পায় নি। অনেকেই তুরস্কের আরারাত বা জুদাই পর্বতে এর অস্তিত্ব আছে বলে মনে করেন। আজও বিজ্ঞানীরা সেই নৌকার খোঁজ করতেছে।
তবে বিজ্ঞানীরা সেই নৌকা খুঁজে না গেলেও আমরা অন্য একটি নৌকাকে পেয়েছি সেই ৯০ দশকে।তবে এটা নৌকা নয় এটা ৯০ দশকের ঝড় তুলা বাংলাদেশী ব্যান্ড আর্ক। যে ব্যান্ডটি তারুণ্যকে দিয়েছে অন্য ধরনের উচ্ছাস। সেই উচ্ছাসের রেশ যেন এখনো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে।আর্ক ব্যান্ডের জম্ম ১৯৯০ সালে। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মিউজিকশিয়ান আশিকুজ্জামান টুলুর হাত ধরে। চাইম ব্যান্ড থেকে বের হয়ে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আর্ক। শুরুতে আর্কের সদস্য ছিল টুলু, পঞ্চম, পার্থ মজুমদার, শামীম, রাজা প্রমূখ, এর পর এল সবার প্রিয় হাসান। মূলত আশিকুজ্জামান টুলু, হাসান ও পঞ্চমের ক্রয়ীর সম্বনয়ে আর্ক এক সোনালী ইতিহাস তৈরি করে। আশিকুজ্জামান টুলু বাংলাদেশের সবচেযে মেধাবী একজন মিউজিকশিয়ান, শুধুমাত্র ব্যান্ডের গান নয় অনেক জনপ্রিয় আধুনিক গানের সুর ও মিউজিক উনি করেছিলেন।ব্যান্ডের গানগুলোকে সহজ, হৃদয়ছোঁয়া এবং জনপ্রিয় করার পিছনে উনার অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা ব্যান্ডের প্রথম মিক্স এ্যালবামও উনার হাতে করা বলতে গেলে টোটাল মিউজিকের একজন পুরাধা বলা চলে উনাকে। পারিবারীকভাবে সংগীত পরিবার থেকে এসেছিলেন উনি। উনার বাবা উস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দীন ছিলেন একজন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আর পঞ্চমও এসেছেন বাংলাদেশের বরেণ্য সঙ্গীত পরিবার থেকে, প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী মাহমুদ নবীর সন্তান উনি আর উনার বোনেরা হলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী ও ফাহমিদা নবী। আর জন্মগত প্রতিভা নিয়ে হাসান যখন আর্কের সদস্য হন তখন আর্ক যেন পরিণত হল একটি মিউজিক ফ্যাক্টরিতে। হাসানের কন্ঠের যথাযত ব্যবহার যেন করতে পেরেছিলেন আশিকুজ্জামান টুলু, বলতে গেলে জহুরীর রত্ন চিনার যেন বাকী ছিল।
১৯৯২ সালে আর্ক প্রকাশ করে তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এই অ্যালবামে ‘সেদিনও আকাশে ছিল চাঁদ’ ও ‘হারিকেন লণ্ঠন’ শিরোনামের দুটি গান ব্যাপক সাড়া জাগায়।১৯৯৬ সালে প্রকাশ করে তাদের ২য় এ্যালবাম 'তাজমহল'।এই এ্যালবামের মাধ্যমে মিউজিকের এক নতুনত্বের ছোয়া দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় কবে, সুইটি, গুরু, পাগল মন, একাকী, তাজমহল, এমন একটি সময় ছিল, ইত্যাদি গান আজও শ্রোতাদের কাছে সমান জনপ্রিয়। বিটিভিতে হাসান যখন তার উঁচু স্কেলে 'একাকি' গানটি গায় শ্রোতাড়া যেন নড়ে চড়ে বসলো। দীর্ঘ দিন ধরে একই ধারার গান শুনতে শুনতে মানুষ যখন বিরক্ত হয়ে উঠছিল, সেদিক থেকে হাসানের গান যেন ছিল ছিল মরুর বুকে হঠ্যাৎ বৃষ্টি। সেই সাথে সফট টাচে 'সুইটি' গানটি গানটি ছিল আর্ক ব্যান্ডের অ্যালবামের অন্যতম হিট গান।গানটিতে প্রেমের মিষ্টি অনুভূতি, সহজ-সরল কথার আবেদন এবং হাসানের উচ্চকণ্ঠের প্রাণবন্ত গায়কী শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিল।' তাজমহল” গানটিও আর্ক ব্যান্ডের এক অমর সৃষ্টি।গানের কথায় চিরন্তন প্রেমের প্রতীক ‘তাজমহল’-এর উপমা ব্যবহার করে প্রেম ও ভালোবাসার যে আকুটি তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গানটিতে পামির মালভূমি, সংগ্রামী যুবকের বিভিন্ন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছে। ৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে গাওয়া গানটিতে হাসান তার ভরাট ও টানটান কণ্ঠ এই গানটিকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। টুলুর গাওয়া 'পাগল মন' গানটিতে গানের কথায় ছিল অস্থির প্রেমের টানাপোড়েন ও সাবধানতার ছাপ।'এমন একটি সময় ছিল' এই গানটি পঞ্চম তার ভরাট কন্ঠে অতীতের সুন্দর মুহূর্তের সময় এক ধরনের হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছে।, যা বর্তমানের দুঃখ-বেদনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।পঞ্চমের কণ্ঠের ভরাট সুর ও হৃদয়স্পর্শী আবেগ গানটিকে যেন আজও জীবন্ত। তাজমহল এ্যালবামের রেশ না কাটতেই ১৯৯৮ সালে প্রকাশ করে তয় এ্যালবাম 'জন্মভূমি'। সাধারণ একটি এ্যালবাম হিট হলে পরের এ্যালবামটি সেরকম হিট করে না। কিন্তু আর্ক তা ভূল প্রমানিত করলো। 'তাজমহল' এ্যালবামের মাধ্যমে আর্ক নিজের জাত চিনিয়েছিল আর জম্মভূমি এ্যালবামে যেন পূর্ণতা পেয়েছিল। এই এ্যালবামের প্রতিটি গান সুপার হিট হয়। স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের কাছে আর্ক হয়ে উঠে এক উন্মাদনার নাম। প্রেম তুমি,প্রতিশ্রতি, আকাশের নীলে, আভিমানে, ঐ দূর পরবাসে, অভিশাপ, যারে রে যা,বাংলাদেশ, ইত্যাদি গান বেশ জনপ্রিয়তা পায। বলতে গেলে এই এ্যালবামের কোন গানকে আলাদা করা যাবে না, সবগুলোই সমানভাবে হিট করেছে। এর মধ্যে 'এত চাই তবুও' গানটি আমার একটি বিশেষ ভাল লাগার গান, গানটির একটি লাইন-ছোট্ট যারা শিশু শ্রমিক, ছোট্ট দুটি হাত, আমানবিক শ্রম বিনিময়ে, অল্প কটা ভাত। গানটির ভিতর শ্রমজীবি মানুষের দুঃখের কথা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, গান যে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় গানের কথায় মানবিক মূল্যবোধ ফুটিয়ে তোলা যায়, আর্ক যেন এই এ্যালবামের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিল। এই এ্যালবামের অসাধারণ সাফল্যের পর ২০০০ সালে বের হয় 'স্বাধীনতা' নামক এ্যালবাম। 'স্বাধীনতা' এ্যালবামটি বের হবার পর হাসান ও পঞ্চম উভয়ই দল ত্যাগ করেন। হাসান 'স্বাধীনতা' নামে আর পঞ্চম 'এজেস' নামে আলাদা ব্যান্ড গড়েন। ২oo৩ সালে আর্ক তাদের শেষ এ্যালবাম 'হারান মাঝি' বের করে। আশিকুজ্জামান টুলু কানাডাতে স্থায়ী হয়ে পড়লে স্বাভাবিক ভাবেই আর্কের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। হাসান ২০১০ সালে আবার আর্কে ফিরে আসেন। আর্ক এখনও স্টেজ পারফর্ম করলেও আর্কের আর নতুন গান বের হয় নি। মূলত টুলু, পঞ্চম ও হাসান, শামিম মিলে যে নতুন নতুন গান নিয়ে শ্রোতাদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেই দিনগুলো সম্ভবত ফিরে আসবে না। নতুন প্রজম্মও হয়তো জানবেও না তারা কি মিস করেছে। আমরা কিন্তু চাই আর্কের মাধ্যমে সুইটিরা ফিরে আসুক বার বার।
আমার এই লেখাটি নিতান্তই নিজস্ব, কাউকে আনিচ্ছাকৃতভাবে ভাবে আঘাত করে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।
ব্যান্ড নিয়ে অন্য লেখা:
হারিয়ে যাওয়া কিছু বাংলা ব্যান্ড।
Link: https://ruposhiban.blogspot.com/2025/07/blog-post.html
তথ্যসূত্র ও ছবি: উইকিপিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে।
লেখক: রম্য রহিম।
Comments
Post a Comment